স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেটের নতুন অধ্যায় "লাইফাই"


চীনা বিজ্ঞানীরা আলোকরশ্মির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার নতুন পদ্ধতি "লাইফাই" উদ্ভাবন করেছেন। এর মাধ্যমে প্রচলিত বেতার তরঙ্গ নির্ভর ওয়াইফাইয়ের চেয়ে অনেক সহজ ও নিরাপদে তথ্য স্থানান্তর করা যাবে। দুর্দান্ত গতির এই নেটওয়ার্ক থেকেই ডাউনলোড করতে পারবেন এইচডি মুভি। আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় ‘চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি ফেয়ার’-এ নতুন প্রযুক্তির অভিষেক ঘটবে। প্রদর্শন করা হবে এই প্রযুক্তি সেবার ১০টি লাইফাই কিটস।

সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি অধ্যাপক ও চীনা গবেষক দলের প্রধান চি নান জানান, নতুন পদ্ধতিতে একটি এক ওয়াটের এলইডি (লাইট এমিটিং ডায়োড) বাতির মাধ্যমে চারটি কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া যাবে।
এক্ষেত্রে বাতিটিই নেটওয়ার্ক ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করবে। বাতিনির্ভর এ পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে লাইট ফিডেলিটি (লাইফাই)।
এ ধরনের বাতিতে অবশ্য বিশেষ কয়েকটি মাইক্রোচিপ সংযোজন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সেকেন্ডে ১৫০ মেগাবাইট গতিতে তথ্য আদান-প্রদান করা যাবে। বিশ্লেষকরা জানান, চীনে প্রচলিত ব্রডব্যান্ডের চেয়ে এ গতি অনেক বেশি।
এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, ইন্টারনেট সংযোগের জন্য আলাদা কোনো ফাইবার অপটিক ক্যাবলের প্রয়োজন হবে না। কেননা, এতে প্রচলিত বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের মাধ্যমেই ইন্টারনেট তথ্য পাঠিয়ে দেয়া যাবে।
প্রযুক্তিটি উদ্ভাবনে ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের কারিগরি সহায়তা দিয়েছে চাইনিজ একাডেমী অব সায়েন্সের নিয়ন্ত্রণাধীন সাংহাই ইন্সটিটিউট অব টেকনিক্যাল ফিজিক্স।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে লাইফাই প্রযুক্তিতে যোগাযোগ উন্নয়নের প্রথম ধারণা দেন জার্মান অধ্যাপক হেরাল্ড হ্যাস। জার্মানির ফ্রনহোফার হেনরিচ হার্জ ইনিস্টিটিউট (এইচএইচআই) এর ল্যাবে লেড বাল্বের মাধ্যমে শুরুতে ৩ জিবিপিএস ডেটা স্থানান্তরে সক্ষম হন তিনি।
এরপর একই পদ্ধতিতে একটি ট্রেড ফেয়ারে ৫০০এমবিপিএস গতিতে ডেটা স্থানান্তর করা হয়েছিল। প্রযুক্তির মান উন্নয়ন নিয়ে এখনো গবেষণা করছেন বর্তমানে যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেরাল্ড হ্যাস।
সম্প্রতি সেখানকার ট্রেড ফেয়ারে তিনি দাবি করেন খুব শিগরই ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির পরিপূরক হবে তার উদ্ভাবিত লাইফাই।
প্রচলিত পদ্ধতির বেজ স্টেশনগুলো সার্বক্ষণিক চালিয়ে রাখতে হয়। এতে ইন্টারনেট ব্যবহার না হলেও শক্তি খরচ হতেই থাকে। আবার এ ধরনের সংযোগের সিগন্যাল সম্প্রচার বন্ধ করে রাখার ক্ষমতাও গ্রাহকদের নেই।
কিন্তু লাইফাইয়ে গ্রাহক চাইলে তার সংযোগটি বন্ধ রাখতে পারবেন। এতে সার্ভারের ওপর চাপ কমবে, পাশাপাশি শক্তি সাশ্রয় হবে অবিশ্বাস্য হারে।
লাইফাইয়ের ধারণাটা অবশ্য একেবারে নতুন নয়। এ নাম সর্বপ্রথম দেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যারাল্ড হাস। তিনিই প্রথম দেখান যে, দৃশ্যমান আলোর (ভিজিবল লাইট কমিউনিকেশন- ভিএলসি) মাধ্যমে নেটওয়ার্কভিত্তিক তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব।
লাইফাইকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন চীনারা। আগামী ৫ নভেম্বর সাংহাইয়ে অনুষ্ঠেয় চীনা আন্তর্জাতিক শিল্প মেলায় ১০টি আলাদা আলাদা ধরনের লাইফাই যন্ত্রাংশ প্রদর্শন করা হবে।
চির মতে, প্রচলিত ওয়াইফাই বেশ ব্যয়বহুল এবং এর দক্ষতাও কম। কিন্তু লাইফাই যেমন সস্তা, তেমনি এর কার্যকারিতাও বেশি। তিনি বলেন, সেলফোনে তথ্য সংযোগ দিতে সারা বিশ্বের কোটি কোটি বেজ স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।
কিন্তু এগুলোর পেছনে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যয় হয়, তার সিংহভাগই যায় সেগুলোকে ঠাণ্ডা রাখতে। এক্ষেত্রে বেজ স্টেশনগুলোর জ্বালানি সক্ষমতা মাত্র ৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, লাইফাইয়ের মাধ্যমে চীনে ইন্টারনেট ব্যবহার আরো জনপ্রিয় হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক দিয়ে অবশ্য এখন বিশ্বের শীর্ষ দেশ চীন। এখানে ৬০ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে।
গবেষকদের দাবি, বেজ স্টেশনের সঙ্গে তুলনা করলে এলইডি বাতির ব্যবহারিক সম্ভাবনা অসীম। কেননা, চীনের প্রায় প্রতিটি বাসাবাড়িতেই এখন স্বল্পমূল্যের অধিক টেকসই এলইডি বাতি ব্যবহার করা হচ্ছে প্রচলিত টাংস্টেন বাতির বদলে।
চি বলেন, যেখানেই এলইডি বাতি, সেখানেই ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া যাবে। বাতি বন্ধ করে দিলে ইন্টারনেটও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে শক্তি সাশ্রয়ও হবে।
জার্মানির ‘দৃশ্যমান আলোক যোগাযোগ বা ভিএলসি প্রযুক্তির ওপর ভর করে এরপরই গ্রাহকদের জন্য এই লাইফাই নেটওয়ার্ক সেবা চালু করতে যাচ্ছে চীন। তবে বাণিজ্যিকভাবে এই সেবা পেতে আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সেবা চালু হলে চীনের বিদ্যমান যে কোনো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের চেয়ে এই নেটওয়ার্ক অধিক দ্রুততার সঙ্গে সেবা দেবে বলে জানিয়েছেন চীনের সাংহাইয়ে অবস্থিত ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক চি নান।
‘চীনের নেটিজেনদের মধ্য খুব দ্রুততার সঙ্গে লাইফাই প্রযুক্তির ইন্টারনেট সেবা বিস্তার লাভ করবে’ উল্লেখ করে চি বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নেটিজেন রয়েছে এখানে, সংযোগ রয়েছে প্রায় ৬০ কোটি। এদের অনেকেই এখন বাড়ির সাধারণ বাল্ব পাল্টে লেড বাল্ব লাগাতে শুরু করেছেন।

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »

Recent Posts